এশিয়ান বাংলা ডেস্ক :  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টাতে আমি সোনামুড়ার মেলাঘর ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ে ছিলাম। এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি ছিল কে’ ফোর্সের অধীন। আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন গেরিলা কমান্ডার ক্যাপ্টেন হায়দার। একদিকে দেশের জন্য যুদ্ধ করব এ উদ্দীপনা বুকের ভেতর অন্যদিকে অনভ্যস্ত কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে গজারি শাল সেগুনের বিশাল বনে কয়েকটি টিলার ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টানানো তিরপলের তাঁবুর নিচে সহযোদ্ধারা একসঙ্গে রাত কাটাই। পাহাড়ে জঙ্গলে ঝুপ করে রাত নেমে এলে কোনো আলো জ্বালানো যেত না। বিভীষিকাময় এমন রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত রবীন্দ্র-নজরুলসঙ্গীত আর দেশাত্মবোধক গানগুলো আমাদের প্রত্যেকের চেতনায় তরল আগুন জ্বেলে দিয়ে আত্মবিসর্জন দেয়ার শক্তি সঞ্চার করত। কোনো কোনো রাতে সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক বদরুল হাসান, যিনি হিং টিং ছট অনুষ্ঠানটি প্রচার করতেন তার কণ্ঠে নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তিসহ কাণ্ডারি হুশিয়ার, শিকল পরার গান, রবিঠাকুরের আমার সোনার বাংলা এসব উদ্দীপনামূলক ও দেশাত্মবোধক গানগুলো বাজত তখন আমরা কেউই তাঁবুর নিচে অলস বসে থাকতে পারতাম না। যে তাঁবুতে ব্যাটারিতে এক ব্যান্ডের ছোট্ট রেডিওটা বাজতো আমরা দলবেঁধে ছুটে গিয়ে সেই তাঁবুর সামনের খোলা আকাশের নিচে ছোট্ট জায়গাতে জড়ো হয়ে সমস্বরে গলা মেলাতাম। তখন আমাদের রক্তে, দেহের শিরায় শিরায় তরল আগুন। এর প্রভাবে অগ্নিতাপের মতো দুর্দমনীয় শক্তি প্রতিটি যোদ্ধাকে যুদ্ধ জয়ের ইন্ধন জোগাত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে অর্ধশত বছর হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। আর আমরা বরাবরের মতোই সগৌরবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মবর্ষ পালন করতে যাচ্ছি। বলা বাহুল্য, জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত মন ও মননের চর্চায় এখনও আগের মতোই সমতালে আমরা উপলব্ধি করি এই কবির বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা। গত শতকে তার আবির্ভাবের কাল থেকে আমরা লক্ষ্য করেছি, যে কোনো সংকটে, বিপদে-আপদে, আন্দোলনে, উত্তরণে-জাগরণে কাজী নজরুলের গান, কবিতা, ভাষণ-অভিভাষণ, বাণীপ্রতিবাদী সচেতন মানুষের রুদ্ধ বাতায়নের অর্গল সহজেই লোপাট করে দেয়, সংকীর্ণ মন-মানসিকতাকে পরিহার করে শুদ্ধ জীবনের পথ দেখায়। আবারিত ফসলের মাঠের ঠিকানা উন্মুক্ত করে দিয়ে যায়।

স্মরণ করি, ১৯২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলাম তখন তিরিশ বছরের টগবগে তাজা তরুণ, প্রাণবন্ত যুবক। বিদ্রোহের জয়তিলক ততদিনে তার ললাটে সেঁটে গেছে। ওই সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে কবি নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে এজন্য যে, বিশ শতক পার করে দিয়ে একুশ শতকের দুটি দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে; কিন্তু কালজয়ী কবির অনিবার্য অবস্থান সময়ের তালে আজও একটুও টলেনি। নেতাজী তার ভাষণে সমকালে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা মূল্যায়ন করতে যেয়ে বলেছেন,

‘তাঁর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মতো বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গান গাইবার ইচ্ছা হতো। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব- তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তাঁর নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির।’

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, গত শতকের শেষ দশক এবং একুশ শতকের দেড় যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চমকপ্রদ আবিষ্কার ইন্টারনেট, বৈশ্বিক অন্তর্জালের প্রসার, বিশ্ব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি জাগতিক পৃথিবীকে বিভক্ত করে উদ্বেগের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পৃথিবীজুড়ে উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান, লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজমের বিকাশ, জেনোফোবিয়া বা আভিবাসীদের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাবের বিস্তার, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনীতির মূলধারায় ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়ার স্থান লাভ এবং এর বিপরীতে ইসলামপন্থী উগ্র চরমপন্থার বিস্তার ঘটেছে। এসব প্রবণতার উপস্থিতি ও শক্তিশালী প্রভাব আগামী পৃথিবীর জন্য কোনো মঙ্গল বার্তা বয়ে আনে না। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ নেতাদের উত্থান।

বর্তমান পৃথিবীর এ অনিশ্চিত যাত্রায় যে ভয় পায় পাক্ বাঙালির ভয় পাওয়ার কিছু নেই। উত্তরণের উপায় আছে আমাদের। যাদের ভাণ্ডারে আছে বাঙালির গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং উন্নত মম শির কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির মন ও মননে নিত্যমর্মসহচর রবিঠাকুরের পরেই নজরুল ইসলামের অবস্থান। যে নজরুল সবসময় চেয়েছেন, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় সাংস্কৃতির রাজনৈতিক ভৌগোলিক অচলায়তন ভেঙে ফেলতে যেটা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসক চায়নি। অন্তরের গভীর উপলব্ধি থেকে উচ্চারণ করেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ’ বলে নজরুল ভৌগোলিক সীমারেখা ভেঙে দিয়েছেন। বলেছেন, অভেদ ধর্ম জাতি/সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে এরা মানুষের জ্ঞাতি।’ মানুষে মানুষে অবিভেজ্যতায় বিশ্বাসী নজরুল এ কারণেই শাসক-শোষক হিন্দু-মুসলিম গোঁড়া সমাজপতিদের বৈরী হয়েছেন। জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করেছেন তথাপি অসত্যের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। অসুস্থ হওয়ার আগে কোনো এক ভাষণে নজরুল বলেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এর অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকদের একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। বিশ শতকের অভিযান সেনাদলের আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল মানুষের মধ্যেকার জাতি-ধর্ম, জাত-পাত, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো ও নারী-পুরুষের ব্যবধান দূর করা। ’(ন র নবম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা- ১৮২)

আমরা জানি, বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঔপনিবেশিক খোলস থেকে বের হয়ে এসে নতুন রূপ নিয়ে হয়েছে বিশ্বায়ন, শোষণের স্থান নিয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে বিকৃতির বাতাবরণে ঢেকে ফেলছে অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি। এর আওতায় দেশীয় সংস্কৃতিকে ঘিরে ধরেছে অপ-আকাশ সংস্কৃতি।

একথা স্বীকার করতেই হবে, প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য প্রবাহে চলতি দুনিয়ায় কোনো দেশ বা জাতি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একাকী পথ চলতে পারে না। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে এবং একইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির পুঁজিবাদী আগ্রাসন থেকে নিজের স্বকীয়তাকে অক্ষুণœ রেখে একইসঙ্গে স্বদেশী এবং আন্তর্জাতিক হতে হবে। নিজের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির প্রতি অবিচল থেকে বিশ্বজনীন হতে হবে আমাদের। ঐতিহ্যের শেকড় থেকে শক্তি সংগ্রহ করে শিখর হিমাদ্রির মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বাঙালিকে।

মানুষের ভেতরে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্তকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন নজরুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার শেকল ভাঙার গান সব শ্রেণীর গেরিলা যোদ্ধাদের মনে স্বাধীন চিত্তের ওই প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে যে প্রদীপটি শিখা অনির্বাণ হয়ে জ্বলছে, অনন্তকাল ধরে জ্বলবে।

কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, নজরুল গেল বিশ শতকে যে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতাকে মানবতার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ উভয় দলের জাতীয় নেতাদের বারবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন একুশ শতকে এসে দেখি এ সাম্প্রদায়িক শক্তিই আজ ভয়ানক উগ্র ও জঙ্গিরূপ নিয়ে আত্মঘাতী মরণ ও মারণ খেলায় মেতে ওঠেছে। ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদকে এসময়ের বিশ্বমানবতার প্রধান শত্র“ বলে মানা হচ্ছে। স্মরণ করি, বিশ শতকের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন। তখন সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণে উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের যে বীজ রোপিত হয়েছিল বিশ শতকের বিশ দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হয় মূলত তারই কারণে।

নজরুল ১৯২৬ সালে ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ বলে সেদিন উপমহাদেশে যারা রাজনীতির কাণ্ডারি, নেতা ছিলেন তাদের উদ্দেশে হুশিয়ারি উচ্চারণ করলেও তারা কেউ সতর্ক হননি। তথাপি কবি তার মাত্র দুই যুগের সৃষ্টিকর্ম জুড়ে পরাধীন দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। বৈরী শাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে যা সত্য তাই উচ্চারণ করেছেন। সত্য বলার দুঃসাহস পেতে হলে আজকাল, আগামীদিন, প্রতিদিন আমাদের নজরুলের কাছে ফিরে যেতে হবে। মানুষের কাছে নিরন্তর এ কবির প্রত্যাশা চীর উন্নত শির মানুষ হয়ে ওঠার। যে মানুষ নির্ভীক, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী, প্রতিবাদী মিছিলের সম্মুখ ভাগের দীপ্ত তারুণ্য।

ফলে বিবেচনা করি, নজরুল সাহিত্য আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে বাঙালির নিরন্তর প্রয়োজনের ও প্রণোদনার উৎস। জানা আছে আমাদের, যে মুক্তি মানুষের কাম্য তা আজও নাগালের মধ্যে আসেনি। প্রতিশ্রুত সাম্য, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই সঙ্গত কারণেই তিনি হয়ে থাকবেন যুগে যুগে মানবতার মুক্তিসংগ্রামে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি। অনাগত কালেও মানুষের জন্য কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে নজরুলের চেতনা ও বিশ্বাসকে ধারণ করা মনে করি, অত্যাবশ্যক।

কবি নজরুল চেয়েছিলেন, মানুষের মুক্তি। তাকে নিন্দুকরা হুজুগের কবি বলে অবমূল্যায়ন করতে চাইলেও কালের বিচারে আজ তিনিই চিরকালের কবি। তার কাব্য, সঙ্গীতের বাণী নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সনদ। যতদিন পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচার শাসকের শোষণ থাকবে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুঁজিবাদী আগ্রাসন চলবে, ধর্মহীনতার সন্ত্রাস মানুষের মুক্ত চেতনাকে রুদ্ধ করে দিতে চাইবে, ততদিন পর্যন্ত নজরুলের প্রতিবাদী চেতনা আলোর দিশা হয়ে পথ দেখাবে। ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, গণআন্দোলনে, জাতীয় সংকটে, বিপর্যয়ে কালে কালে নজরুল ইসলাম যে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন তার কারণ এ-ও তো যে, তিনি আমাদের চিরকালের অমোঘ সাহস, সত্য ও প্রত্যয়। বন্ধন মুক্তির সংগ্রাম। আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বরলিপি। অনির্বাণ শিখা।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version