এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বিদেশি কোচদের নামে প্রায় চার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়ে ফেঁসে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বছরের পর বছর ধরে কর ফাঁকি দিয়ে এলেও এবার আর পার পাচ্ছে না। নতুন কোচ জেমি ডে’র বেতন দেয়ার সরকারি অনুমোদন নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে বাফুফে।

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগকে ফুটবল কোচের বেতন বিদেশি ব্যাংকে পাঠানোর অনুমতি দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। তবে অন্যান্য বারের মতো গতানুগতিক চিঠি দেয়নি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। চিঠিতে জেমি ডে’র বেতন বাবদ সরকারের পাওনা রাজস্ব কেটে রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। আর এতেই ফাঁস হয়ে গেছে বাফুফের এতদিনের কর ফাঁকি দেয়ার ঘটনা।

দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন বাংলাদেশে খেলতে আসা বিদেশি খেলোয়াড় ও কোচরা। শুধু তাই নয়, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন এসব বিদেশি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) হাফ ডজন বিদেশি কোচ কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে বিসিবির চুক্তির কপি বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টে (বিওআই) জমা দেয়া হয়।

তারপর নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্সের জন্য পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই থেকে ছাড়পত্র নেয়া হয়। যখনই বিদেশি কোচরা বিসিবিতে কাজ শুরু করেন, তখনই তাদের আয়ের অর্থ থেকে আয়কর কেটে নিয়ে রাজস্ব বিভাগে জমা দেয় বিসিবি। যখন একজন কোচ মেয়াদ শেষে বাংলাদেশ থেকে চলে যান, তখন ইমিগ্রেশনে ট্যাক্স পরিশোধের সনদপত্র দেখাতে হয়। আর এখানেই রয়েছে ফুটবল কোচদের শুভঙ্করের ফাঁকি।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) একই কায়দায় বিদেশি কোচদের নিয়ে আসে। নিয়মানুযায়ী কোচদের বেতনের ৩০ ভাগ আয়কর দিতে হবে। কিন্তু বাফুফে বিদেশি কোচদের সঙ্গে যে চুক্তি করছে, তাতে আয়কর বাফুফেরই দেয়ার কথা, যা আয়কর আইনের পরিপন্থী। বাংলাদেশের আইটি অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ এর ২(৪২) ধারায় বলা হয়েছে, বিদেশি নাগরিকদের আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ দিতে হবে।

এই অর্ডিন্যান্সের ১৬৫ ও ১৬৬ ধারায় আয়কর ফাঁকি দেয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানা ও ফৌজদারি আইনে মামলা করার বিধান রয়েছে। বাফুফে অবৈধ চুক্তি করে বিদেশি কোচদের আয়কর ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করে আসছে। অথচ বাফুফের উচিত ছিল কোচদের কাছ থেকেই আয়কর কেটে রেখে তা রাজস্ব বিভাগে জমা দেয়া।

ব্রাজিলিয়ান এডসন সিলভা ডিডো, সার্বিয়ার জোরান দর্দোভিজ, ক্রোয়েশিয়ার রবার্ট রুবচিচ, মেসিডোনিয়ার নিকোলা ইলিয়েভস্কি, নেদারল্যান্ডসের লোডভিক ডি ক্রুইফ, রেনে কোস্টার, ইতালির ফ্যাবিও লোপেজ, স্পেনের গঞ্জালো মরেনো, বেলজিয়ামের টম সেইন্টফিট, অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্র– অর্ডের বেতন বাবদ সরকারের পাওনা ৩০ ভাগ আয়কর রাজস্ব বিভাগে জমা দেয়নি বাফুফে।

এসব কোচের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চাকরিচ্যুত অথবা চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। মাসিক ১০ লাখ টাকা বেতন দিয়ে ব্রিটিশ বংশদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলিকে পুষছে বাফুফে। দু’বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করা স্মলিকে আড়াই কোটি টাকা বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। স্মলির আয়কর বাবদ প্রায় ৭৫ লাখ টাকা রাজস্ব জমা হওয়ার কথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। যার একটি টাকাও দেয়নি বাফুফে।

২০১৭ সালের মে’তে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পাওয়া অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড্র– অর্ড চলতি বছরের মার্চে ভেগে যান। অর্ড মাসিক আট লাখ টাকা বেতন-ভাতা হিসেবে পেয়েছিলেন প্রায় ৯০ লাখ টাকা। এ বাবদ রাজস্ব খাতের ২৬ লাখ টাকা হাপিস করে দিয়েছে বাফুফে। অর্ডের ভেগে যাওয়ার পর বাফুফে ইংল্যান্ডের এক নিুমানের কোচ জেমি ডে’কে নিয়োগ দিয়েছে। এর পাশাপাশি গোলকিপার কোচ পল ওয়াটকিস এবং ফিটনেস কোচ পল ডেভিস কাজ করছেন।

এই তিনজনের বেতন-ভাতা তাদের বিদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠানোর জন্য অনুমতি চেয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল বাফুফে। কিন্তু আয়কর কেটে রাখার কথা বলায় ফেঁসে গেছে দেশের ফুটবলকে ফিফা র‌্যাংকিংয়ের তলানিতে নিয়ে যাওয়া এই সংস্থাটি। বিদেশি কোচদের আয়কর মওকুফ চেয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে চিঠি দিয়েছেন বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। কিন্তু তাতেও হালে পানি পাচ্ছেন না তারা। কেননা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিদেশি কোচরা আয়কর দিতে বাধ্য। এতদিন ধরে আয়কর ফাঁকি দেয়ায় বাফুফের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত বলে ফুটবলবোদ্ধারা মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘বিদেশি কোচদের আয়কর দেয়ার কথা বাফুফের। আমরা তা দিইনি, এটা সত্যি। তবে চুক্তি যে আয়কর আইনের পরিপন্থী তা আমার জানা ছিল না। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

এদিকে বাংলাদেশে ১২ বছর ধরে চালু রয়েছে পেশাদার ফুটবল লিগ। বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে ক্লাবগুলোর চুক্তির কপি বাফুফের কাছে জমা থাকে। বিদেশি ফুটবলারদের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন ডলারে। অথচ ব্যাংকের মাধ্যমে না পাঠিয়ে বিদেশি ফুটবলাররা হুন্ডির মাধ্যমে ডলার পাঠিয়ে দেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিদেশি ফুটবলাররা প্রতি বছর কমপক্ষে ৩০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেন, যার পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেন। আয়করও দেন না তারা। শুধু যে বিদেশি খেলোয়াড়রাই আয়কর দেন না তা নয়, দেশি খেলোয়াড়রাও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন। আর এ আয়কর ফাঁকির ঘটনা ঘটছে বাফুফের জ্ঞাতসারেই।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version