এম মাহাবুবুর রহমান

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর দ্যা মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে লিখেছেন, ”How far that little candle throws his beams! So shines a good deed in a weary world”. অর্থাৎ ওই ছোট মোমবাতি কতদূর-ই-বা তার আলোকরশ্মি ফেলতে পারে! অতএব, ভাল কর্ম দিয়ে একটি ক্রমশ: ক্লান্ত হয়ে পড়া পৃথিবীকে আলোকিত করো।

ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা দ্যা মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে শেক্সপিয়ার রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রেম-ভালবাসার প্রলেপে সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই নাটকে আবহমান কালের পুরো সমাজব্যবস্থার চিত্র ফুটে ওঠায় শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ এটিকে গ্রহণ করেছে।

আর মহৎপ্রাণ মানুষেরা উপরেল্লিখিত শেক্সপিয়ারের দুই লাইনের মন্তব্যটিকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করছেন। ধরুন, একজন ভাল রাজনীতিবিদের জীবনের প্রধান কাজ-ই হলো মানুষকে সহায়তা করা। সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সামনে এগিয়ে নেয়াই তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এভাবে যুগে যুগে মহান ব্যক্তিগণ তাদের মহান কীর্তি দিয়ে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর তাঁরা তাদের কর্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান এমনই একজন কর্মবীর, সৎ ও দেশপ্রেমিক মহান পুরুষ। অভিজাত পারিবারিক উত্তরাধিকারকে বহন করার পাশাপাশি তিনি নিজে আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের  শিক্ষা-প্রশিক্ষণে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। আর এই সমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডার ও অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশ ও জাতি গঠনে কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।  আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনে তিনি ছুটে বেরিয়েছেন বিশ্বজুড়ে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই মহান পুরুষ কাজে-মননে নিজেকে প্রমাণ করেছেন একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে।

তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালের ৩ নভেম্বর সিলেট জেলার বিরাহীমপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান ছিলেন নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ও আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। হায়দ্রাবাদ নিজামের প্রধান আইন উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তৎকালীন ভারতে তিনি ১৯০১ সালে প্রথম মুসলিম হিসেবে ব্যারিস্টার ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর ঝুলিতে ছিল ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ডিগ্রী।

মাহবুব আলী খানের মাতার নাম জুবাইদা খাতুন। তিনি অবিভক্ত বিহার, আসাম ও উড়িষ্যার জমিদার পরিবারের খান বাহাদুর ওয়াসিউদ্দিন আহমেদ এর কন্যা।

Makhanmemorial.com ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য মতে, মাহবুব আলী খান ১৯৫৫ সালে সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যা শাহিনা খান জামান (বিন্দু) এবং ডা. জুবাইদা রহমান (ঝুনু)।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সামরিক উপদেষ্টা সৈয়দ শফিউজ্জামান তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় পুত্র এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর কনিষ্ঠ জামাতা। তারেক রহমান ও ডা. জুবাইদা রহমানের কন্যা ব্যারিস্টার জায়মা রহমান হলেন মাহবুব আলী খানের একমাত্র নাতনি। জায়মা রহমান লন্ডনের কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বিপিপি ইউনিভার্সিটি থেকে বার প্রফেশনাল ট্রেইনিং কোর্স (বিপিটিসি) সম্পন্ন করার পর ‘ইনার টেম্পল থেকে বার অ্যাট’ ল অর্জন করেন।

বাবার পেশার কারনে মাহবুব আলী খান প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন কলকাতা ও ঢাকায়। ছাত্রাবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন এবং কোয়েটায় সম্মিলিত বাহিনী স্কুল থেকে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

তিনি শুধু গতানুগতিক চাকুরির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। নৌবাহিনীতে যোগদানের পর তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে   উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য গমণ করেন। সেখানে ডারমাউথ রয়্যাল নেভাল কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এসময়ে তিনি ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রায়ামপতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালের ১ মে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের গ্রিনউইচে অবস্থিত রয়্যাল নেভাল কলেজ ইনস্টিটিউশন থেকে প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৩ সালে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার কোর্সে অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষর রাখায় বৃটেনের রানী এলিজাবেথ তাকে শ্রেষ্ঠ কৃতী অফিসার হিসেবে পুরস্কৃত করেন।

এছাড়া তিনি পাকিস্তানের নেভাল স্টাফ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন এবং করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করেন।

অর্জিত আধুনিক জ্ঞান ও পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি নৌবাহিনীর চাকুরিতে নিজের দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সময়ের আবর্তে তিনি ১৯৬৭-৬৮ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফ সেক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার  (ট্রেইনিং এবং মিলিটারি অ্যাসিস্ট্যান্স) হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭০ সালে তাকে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন স্কুলের অফিসার-ইন-চার্জ এবং করাচিতে সিওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তানে সপরিবারে তিনি জীবন শঙ্কার মধ্যে পড়েন। প্রিয় মাতৃভূমিতে ফেরার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি। আর তা টের পেয়ে যায় পাকিস্তান সরকার এবং তাকে সপরিবারে গৃহবন্দি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন।

https://www.makhanmemorial.com/ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ”REAR ADMIRAL MAHBUB ALI KHAN: A SYMBOL OF HARD WORK AND INTEGRITY” শীর্ষক এক নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ফেরত আসার পর মাহবুব আলী খান চট্টগ্রামে মার্কেন্টাইল একাডেমির প্রথম বাঙালি কমান্ড্যাট নিযুক্ত হন। এরপর তিনি নৌ-সদর দফতরে পারসোনেল বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি নৌবাহিনীর সহকারী স্টাফ প্রধান (অপারেশন ও পারসোনেল) নিযুক্ত হন।

এরপর মাহবুব আলী খান স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে পরিচিত করে তুলতে কাজ করার সুযোগ পান। বিশেষ করে নৌবাহিনীর কর্মকান্ডকে নানাভাবে আন্তর্জাতিকায়ন করতে নিজের মেধা, জ্ঞান ও সাহসকে কাজে লাগান।

১৯৭৬ সালে বৃটেনের রয়্যাল নেভি স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে প্রথম একটি রণতরী বিএনএস ওমর ফারুক (সাবেক এইচএমএএস ল্যান্ডাফ) প্রদান করে। তিনি এই রণতরীর অধিনায়ক হন। এ রণতরী নিয়ে তিনি আলজেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে শুভেচ্ছা সফর করেন। এই সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীপথে রণতরীর মুভমেন্ট বিশ্বের কাছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের বার্তাকে আরো স্পষ্ট করে।  মাহবুব আলী খানের এমন সাহসী নানাবিধ কাজের স্বীকৃতিও মেলে তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর তিনি নৌবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল পদে উন্নীত হন।

রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের নৌসম্পদের নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার করা হয়।  ১৯৮০ সালে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বিবদমান নদীসম্পদ নিয়ে নানাবিধ উদ্যাগ গ্রহণ করে। তখন ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার। ওইবছরই প্রথম বাংলাদেশ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা দাবি করে। রেডক্লিফের দেশভাগ অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত দক্ষিন তালপট্টির পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় দ্বীপটির মালিকানা বাংলাদেশ – এমন দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে, ভারত ১৯৮১ সালের মে মাসে সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে তাদের পতাকা ওড়ায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ভূখণ্ড ঐ দ্বীপটি রক্ষার জন্য রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের নেতৃত্বে তিনটি নৌ জাহাজ পাঠান। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে ভারতের সামরিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপের বিষয়টি ১৯৮১ সালের ১৭ মে তৎকালিন সবগুলো বাংলা দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কাছাকাছি সময়ে বিদেশী পত্রিকাগুলোতেও এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

১৯৮১ সালে ২০ মে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা ‘A little pile of mud could start a war’ শিরোনামে লেখে, “১৯৭৪ সালে প্রায় ১২বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি সনাক্ত করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সেখানে গানবোট প্রেরণ করলে বাংলাদেশও গানবোট প্রেরণ করে।

যদিও ভারত কর্তৃপক্ষ একটি যৌথ জরিপের মাধ্যমে দ্বীপটির মালিকানা নিষ্পত্তিতে রাজী হয়েছিলো। সার্ভে অব বংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত টপোশিটে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা করেছিলো তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার, যার প্রমান তৎকালীন টপোশিটে তালপট্টির অবস্থান।

এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে একটি কুচক্রীমহল হত্যা করে। তাঁর শাহাদতের পর ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে যৌথ জরিপ না করেই আবারো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তালপট্টিতে তাদের সৈন্য এবং ফ্রিগেট প্রেরণ করলে তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান আবারো সেখানে গানবোট প্রেরণ করেন। মাহবুব আলী খানের এমন সাহসী সিদ্ধান্ত তখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাহবা পায়। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ রক্ষায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে তিনি অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। এই বিষয়ে ১৯৮১ সালের ২০ আগস্ট বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার তাঁর উদৃতি দিয়ে “South Talpatti Island is Ours : M H Khan” শিরোনামে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিলো। একইভাবে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিলো বিদেশী পত্রিকাতেও। ১৯৮১ সালের ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত আবজারভার-রিপোর্টার পত্রিকায় ‘India, Bangladesh Quarrel Over Island’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিলো, “ভারতের ফ্রিগেট ও বাংলাদেশের গানবোটগুলো নিউমুর বা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের কাছে পরষ্পেরর মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে। ভারত কর্তৃক যৌথ জরিপের বিষয়টি অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে এই অবস্থার উদ্ভব হয়েছে।”

১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারিকালে এডমিরাল মাহবুব আলী খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয় তাকে। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সরকারের দায়িত্ব পালনকালে তিনি যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অবদান রাখেন। তবে এসময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি দেশের পক্ষে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখেন। ১৯৮২ সালের জুন মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ওই বছরের  নভেম্বরে তিনি রাশিয়া যান এবং প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর ডিসেম্বরের ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত সমুদ্র আইন বিষয়ক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কনভেনশন অন সি কনফারেন্সে অংশ নেন। ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান নৌ, রেল ও সড়ক প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন এবং চীনের নৌঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। এসকাপের উদ্যোগে ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে মন্ত্রীদের সভায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর জুলাই মাসে তিনি কোরিয়া সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

সর্বশেষ ১৯৮৪ সালের ৩০ মার্চ তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আমদের সেকুতুরের শেষকৃত্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে চট্টগ্রাম হতে ঢাকাগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার এফ ২৭-৬০০ যাত্রীবাহী বিমান তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটস্থ জলাভূমিতে বিধ্বস্ত হলে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দেবার জন্য সেখানে যান।  প্রায় ১২ ঘণ্টা উদ্ধার কাজ করার পর গভীর রাতে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলে বাসায় ফেরত আসেন। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে চিকিৎসার জন্য ঢাকা সেনানিবাসস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ওই দিনই তিনি চিকিত্সাধীন অবস্থায়  মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান কম বয়সে মৃতু্যবরণ করলেও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে। নৌবাহিনীর বিভিন্ন প্রকল্প এবং বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর সাথে মিশে আছে এই মহান ব্যক্তির নামটি। বাংলাদেশের নৌসম্পদ বিশেষত: তালপট্টি দ্বীপের ইতিহাসের সাথে এই দেশপ্রেমিক অসম সাহসী বীরের নাম যুক্ত থাকবে, যতদিন রবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব।

কারো অনুগ্রহে কিংবা চাটুকারদের শ্লোগানে নয়, রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ইতিহাসের পাতায় বেঁচে আছেন নিজ কৃতকর্মে। সততা, নিষ্ঠা ও সাহসিকতার মাধ্যেম তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছন। শুধু পারিবারিক ঐতিহ্য ও বংশ পরম্পরা নয়, মাহবুব আলী খান ছিলেন সর্বদিক থেকে পরিপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব – যার ছিল বর্ণাঢ্য বংশমর্যাদা আবার নিজে পাশ্চাত্যের শিক্ষা অর্জন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজে জ্ঞানের পূর্ণতা অর্জন করেছেন। আবার, পেশায় সততা ও কর্মনিষ্ঠা আর অসম সাহিসকতায় তিনি একজন সফল মানুষে পরিণত হয়েছেন।

রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের স্মৃতিচারণে আমরা যুক্তরাষ্ট্রর ১৬তম প্রেসিডেন্ট Abraham Lincoln এবং গ্রীক দার্শনিক Lucius Mestrius Plutarch দুইটি উক্তিকে স্মরণ করতে পারি। Abraham Lincoln বলেন, “I don’t know who my grandfather was, I am much more concerned to know what his grandson will be.” Plutarch বলেছেন, “It is a desirable thing to be well-descended, but the glory belongs to our ancestors.”

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version